বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল নিয়ে স্নাতকোত্তর। বর্তমানে লাভপুর যাদবলাল উচ্চ বিদ্যালয়ে ভূগোলের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত আছেন।
রবীন্দ্র দর্শনে বিশ্বাসী ভূগোল প্রেমিক লেখক পাহাড় আর জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে ভালো বাসেন। শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় থেকেই প্রকৃতির উন্মুক্ত অঙ্গনে খোলা হাওয়ায় বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। প্রকৃতির সাথে একটা আন্তরিক যোগ গড়ে উঠেছে। তাই নাগরিক বাঁধন খুলে বার বার ছুটে গেছেন পাহাড় আর জঙ্গলের কোলে। পাহাড় জঙ্গল ঘেরা প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে ট্রেকিং-ই সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় বলে মনে হয়েছে তার কাছে। এতে করে প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ মেলে। পৌঁছানো যায় প্রকৃতির দুর্গম গহন অন্তরে।
বিভিন্ন পত্র পত্রিকার মাধ্য দিয়ে লেখালিখি শুরু। লেখকের প্রকাশিত প্রথম বই 'গন্তব্য গুরুদংমার' পাঠক মহলে বিশেষ সমাদৃত হয়েছে। 'অন্নপূর্ণার পাদদেশে' লেখকের প্রকাশের পথে।
ভারতের দীর্ঘতম নদী গঙ্গার উৎপত্তি হয়েছে উত্তরাখণ্ডের গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ গুহা থেকে। দুর্গম পাহাড়ি পথ বেয়ে সেই উৎসে পৌঁছানোর রোমাঞ্চকর কাহিনী, তার সাথে মাউন্ট শিবলিঙ্গকে ছুঁয়ে দেখার রুদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতা এই গ্রন্থে তুলেধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
এই বই সম্পর্কে দু-চার কথা
তপোভূমি ভারতবর্ষ সমৃদ্ধ হয়ে রয়েছে অসংখ্য তীর্থস্থান এবং মন্দিরে। এর মধ্যে সর্বাধিক পবিত্র স্থান হিসেবে হিমালয় ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে দেবাদীদেব মহাদেবের স্থল হিসেবে মনে করা হয়। বিস্তীর্ণ হিমালয়ের মধ্যে বিশেষত উত্তরাখন্ড রাজ্যের হরিদ্বারকে দেবস্থলে পৌঁছনোর দরজা হিসেবে ধরা হয়। বহু মুনি ঋষি এই পথ ধরে যুগ যুগ ধরে পদব্রজে পৌঁছে গেছেন তাঁদের আরাধ্য দেবতার কাছাকাছি। কোথাও এক বেলা হেঁটে, আবার কোথাও বা সপ্তাহ ব্যাপী হেঁটে পৌঁছানো যায় ওই সকল স্থানে। বহু ঋষির পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রাচীনতম এই পথ ধরে সঞ্জয় দে মহাশয় তাঁর সহযাত্রীদের সাথে পৌঁছে গেছেন তাঁর নির্দিষ্ট গন্তব্য গঙ্গোত্রী মন্দির, মা গঙ্গার উৎপত্তি স্থল, গোমুখ ও মাউন্ট শিবলিঙ্গের পদতলে, তপোবনে। তাঁর লেখনীর যাদুস্পর্শে এই পূর্ণ ভূমি, পাঠকের কাছে রং হীন থেকে রঙ্গীন হয়ে উঠেছে। তুলির ছোঁয়ায় নির্জীব থেকে সজীব হয়ে প্রস্ফুটিত হয়েছে। তিনি তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা অতি যত্ন সহকারে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর এই পুস্তকটিতে। এই অঞ্চলে পথের সৌন্দর্য, গিরিখাতের বর্ণনা আমাকে সুদূর আমেরিকার কলোরাডো নদী তীরে অবস্থিত গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। এই বইটিতে লেখকের প্রকৃতিপ্রেম এবং তাঁর সৌন্দর্য্য পিপাসু মনের খোঁজ পাওয়া যায়। রূপ রস, সৌন্দর্য্য ও অ্যাডভেঞ্চারের আকর্ষণের তিনি ছুটে গেছেন এই সমস্ত অঞ্চলের। ঐ দুর্গম রাস্তায় প্রকৃতির ভয়াল রূপ ধরা পড়েছে। প্রকৃতির খেয়ালে পূর্ববর্তী রাস্তা নিমেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ায় লেখক নুতন তৈরি রাস্তায় মা গঙ্গার উৎপত্তিস্থলে পৌঁছে গেছেন। বিজ্ঞানের এত অগ্রগতির সত্ত্বেও প্রকৃতির কাছে প্রযুক্তি নেহাতই শিশু। আগামী দিনের ভ্রমনার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত খুঁটিনাটির সম্ভার নিয়ে হাজির হয়েছেন লেখক তাঁর এই বইটিতে। এই বইয়ের সাহায্যে ও তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে পরবর্তীতে মানুষজন নিখুঁত ভাবে ভ্রমণ সম্পন্ন করতে পারলেই হবে এই বইয়ের সার্থকতা। আশা রাখি পাঠকদের জন্য এই প্রকারের উপহার তিনি আগামীতেও দেবেন। আমি বইটির বহুল প্রচার ও সাফল্য কামনা করি। একই সাথে প্রকাশক 'বই-ঘর শান্তিনিকেতন' এর ঝুলিরও শ্রীবৃদ্ধি ও পূর্ণতার আশা রাখি।
ড. সন্দীপ পান
(শিক্ষক, পদার্থ বিদ্যা, লাভপুর যাদবলাল উচ্চ বিদ্যালয়)
৫ ডিসেম্বর ২০২৪
'চিত্রিতা', ৪/৬০, প্রান্তিক উপনগরী
প্রান্তিক, শান্তিনিকেতন
পাঁচ। তপোবনের পথে ...
ভুজবাসা (ভোজবাসা) থেকে সকাল সকাল তপোবনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। নদীর ধারেই আমাদের ক্যাম্প ছিল। তপোবন যেতে গেলে এখানে খরস্রোতা ভাগীরথী পার হতে হয়। ভাগীরথী এখানে দুটি চ্যানেলে প্রবাহিত হয়েছে, নদীর জল তুলনামূলক কম কিন্তু স্রোত খুব বেশী, তাই হেঁটে নদী পারাপার করা যায় না। নদী পার হবার জন্য এখানে অভিনব এক পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। নদীর দুই দিকে ১২ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতার দুটি কংক্রিটের পিলার বানানো আছে। তার সাথে দুই মাথায় দুটি কপিকলের সাহায্যে একটা লোহার ক্যাবেলকে শক্তপোক্ত ভাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। মাঝখানে ট্রলারকে পাখির খাঁচার মত করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, অনেকটা রোপওয়ের মত। এবার রশি টেনে টেনে ট্রলারকে পর্যায় ক্রমে এমাথা থেকে ওমাথায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। একসাথে জনা চারেক পারাপার করতে পারে। মাঝে মধ্যে পোর্টারদের মালপত্রও এই ট্রলি করে পরিবহণ করা হয়। আমরা ক্যাম্প ছেড়ে আটটার দিকে নদীর ঘাটের কাছে এলাম, এসে দেখি ইতিমধ্যেই অনেক লম্বা লাইন পরে গেছে, তাদের কেউ গোমুখ কেউবা তপোবন যাবেন। সেই লাইনে কয়েকজন বিদেশীও আটকে আছে। একসাথে চার জনের বেশী পারাপার হচ্ছে না। বাধ্য হয়েই দাঁড়িয়ে রইলাম। এক একবার পারাবারের জন্য কমপক্ষে পনেরো থেকে কুড়ি মিনিট সময় লাগছে। পিলারের মাথায় বসে একজন ক্যাবেল আর ট্রলি নিয়ন্ত্রণ করছে, আর নীচে দুই তিনজন পোর্টার রশি ধরে কখনও টানছে, কখনও ঠেলছে। দেখে মায়া হলো, কি পাশবিক পরিশ্রমই না তাদেরকে করতে হয়! ঘন্টা দুয়েক দাঁড়িয়ে থাকার পর আমাদের পালা এল।
নদীর উল্টো পিঠে পৌঁছে দেখি ওপারে আর রশি টানার কোন লোক নেই।
যে কয়েকজন পোর্টার রশি টানাতে এতক্ষণ হাতলাগিয়ে ছিলেন, দেরি হচ্ছে দেখে তারা গন্তব্যে রওনা দিয়েছে। আমাদের টিমের এখনো চারজন উল্টো পাড়ে আটকেই আছে! বাধ্য হয়ে আমরাই হাত লাগলাম রশি টানতে। তবে যেটুকু বোঝা গেল, মাত্র একজন ছাড়া এই পরিষেবা প্রদানের স্থায়ী কোন কর্মচারী নেই। পোর্টার, গাইড বা স্থানীয়রাই তাদের প্রয়োজন মত এই পরিষেবায় হাত লাগায়। এই রকম আদিম প্রথায় নদী পারাপার এই প্রথম দেখলাম!
আগে ভোজভাসা থেকে ভাগীরথীর ডান পাড় বরাবর একটা রাস্তা দিয়ে গোমুখ হয়ে তপোবন যাওয়া যেত। অত্যধিক ধ্বস আর হিমবাহের দ্রুত গলনের ফলে সে রাস্তা এখন পরিত্যক্ত বন্ধ আছে। হয়তো বিকল্প হিসেবে নদী পারাপারের এই ব্যবস্থা।
নদী পারাপারের পর, টিমের বাকিদেরকে সঙ্গে নিয়ে আবার পথ চলা শুরু করলাম। ভোজবাসার পর থেকেই হঠাৎ কেমন বদলে গেল উদ্ভিদ বৈচিত্র। পুরোটাই ব্যারেন ল্যান্ড। সবুজ বদলে গেল পাংশু বর্ণে। দুএকটা লাল হলুদ শুকনো তৃণ গোত্রীয় উদ্ভিদ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়লো না। কারও বা পাতা রূপান্তরিত হয়েছে কাঁটায়। নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য জৌলুসহীন দু একটা ছোট সাদা ফুল, নিজেদের প্রস্ফুটিত রেখে বেঁচে থাকার মারিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
একটা সরু পায়ে চলা পথ সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। সেটিকে অনুসরণ করেই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে চলা। কিছুটা দূরে যেতে না যেতেই সে পথ কোথায় যেন বোল্ডারের ফাঁকে মিলিয়ে গেল। সত্যি বলতে এর পর পথ বলে আর কিছুই নেই। শুধুমাত্র ছোট বড় বোল্ডারকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। এই ভাবে প্রায় ঘন্টা খানেক হাঁটার পর দেড় কিমি অতিক্রম করে একটা জায়গায় পৌঁছলাম। গুগল ম্যাপ অনুযায়ী জায়গাটির নাম ভারওয়াড়ি (Bharwari)..
৩১